লটকন চাষ করে ভাগ্য
বদল করছেন
নরসিংদীর শত শত চাষি
অপর্ণা বড়–য়া
নরসিংদীর পাহাড়ি এলাকার বাগানগুলোতে এখন শুধু সোনালি লটকনের সমারোহ। এক সময়ের বনজ ফল হিসেবে পরিচিতি থাকলেও বর্তমানে লটকন লোভনীয় ফল হয়ে দেশে-বিদেশে বৃহৎ বাজার অর্জন করেছে। প্রতিনিয়ত বাড়ছে নতুন নতুন বাগান। ভাগ্য বদলেছে অসংখ্য বেকার যুবক-কৃষকের। কৃষি জমি ও বাড়ির আঙ্গিনায় চাষাবাদ হওয়া সুস্বাদু লটকন এখন দেশের সীমানা পেড়িয়ে রপ্তানি হচ্ছে বিদেশেও। দেশ-বিদেশের বাজারগুলোতে এর চাহিদাও রয়েছে ব্যাপকহারে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে লটকন ফল উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে বলে দাবি করছে লটকন আবাদকারী কৃষকরা। কম খরচ আর অল্প পরিশ্রমে ফলন ও মূল্য দুটোই ভালো হওয়ায় লটকন এখন চাষিদের কাছে অন্যান্য ফসলের তুলনায় অর্থনৈতিক ভাবে লাভজনক ফল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। বিদেশ ফেরত বহু বেকার যুবকও লটকনের চাষ করে তাদের মুখে ফুটিয়েছে অর্থনৈতিক সাফল্যের হাসি। লটকনে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন‘বি-২’ ও ভিটামিন ‘সি’ রয়েছে। এ ছাড়া ফলটি ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লৌহসহ বিভিন্ন খনিজ উপাদানে সমৃদ্ধ। যার ফলে মানবদেহে দৈনিক যে পরিমাণ ভিটামিন ‘সি’র প্রয়োজন হয়, মাত্র তিন-চারটি লটকন সে চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট। টক আর মিষ্টিতে ভরপুর এখানে উৎপাদিত ফলটি হাজারো চাষিদের ভাগ্য বদলে দিয়েছে। তাই অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হওয়ায় বাণিজ্যিকভাবে এখানকার কৃষকরা শুরু করেছে এর আবাদ।
লটকন ফলনে তেমন কোনো খরচ নেই। স্ত্রী গাছ লাগিয়ে দিলেই হয়। সময়ে সময়ে একটু পরিচর্যা করতে হয়। গোড়ার চারদিকে জৈবসার দিলে ফলন ভালো হয়। লটকন গাছের রোগবালাই তেমন দেখা যায় না। ফল সংগ্রহের ৬০দিন আগে গাছ প্রতি ৫০ গ্রাম পটাশ পানির সঙ্গে মিশিয়ে গাছের গোড়ায় দিলে ফলের মিষ্টতা ও আকার বৃদ্ধি পায়। প্রতি মৌসুমে এখানকার লটকন চাষিরা প্রায় ২০ থেকে ২৫ হাজার মেট্রিকটন লটকন উৎপাদন করছে। নরসিংদীর উৎপাদিত লটকন দেশে-বিদেশে প্রায় ১২০ থেকে ১৫০ কোটি টাকা বাজারমূল্য ধরে রেখেছে বলে কৃষি কর্মকর্তা ও কৃষকরা জানিয়েছেন।
বেলাব উপজেলার লাখপুর গ্রামের লটকন চাষি রাসেল মিয়া বলেন, স্থানীয় বাজার ছাড়াও লটকনের ফলন ধরার পর জমিতেই পাইকারি বিক্রি করে দেয়া যায়। পাইকাররা বাগান কিনে দেশে বিদেশের বাজারে পাঠিয়ে থাকেন।
বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ (এপ্রিল-মে) মাস চারা রোপণের উপযুক্ত সময়। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে খরিপ মৌসুমে ১ হাজার ৬৭৩ হেক্টর জমিতে লটনকনের বাগান করা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লটকন চাষ হয়েছে শিবপুরে। প্রতি কেজি লটকন স্থানীয় বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকা দরে। কামারটেক, চৈতন্য, জয়মঙ্গল, রায়পুরা ও বেলাবরের বিভিন্ন বাজারে প্রতিদিন প্রায় ৫০ থেকে ৮০ লাখ টাকার লটকন বিক্রি করে থাকে। বেলাব উপজেলার কৃষক আহসান উল্লাহ ভূঁইয়া জানান, দিনে দিনে আমাদের এলাকায় লটকনের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্যাপারীরা এখন লটকন কিনে বিদেশও পাঠাচ্ছে। লটকন ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানান, নরসিংদীর বাজারগুলোতে লটকন মৌসুমে প্রতিদিন কাকডাকা ভোর থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত প্রায় ৫০ লাখ টাকা এবং বাগান থেকেও প্রায় ৩০ লাখ টাকার লটকন বিক্রি করা হয়ে থাকে।
২০০৮ সাল থেকে দেশের চাহিদা মিটিয়ে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয় এখানকার সু-স্বাদু এ লটকন ফল। কিন্তু ২০২০ সালে করোনা মহামারি কারণে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট সাময়িক বন্ধ থাকায় লটকন দেশের বাইরে রপ্তানি করা যায়নি। তবে বর্তমানে সঙ্কট কেটে যাওয়ায় আবারো লটকন বিদেশে রপ্তানি শুরু হবে বলে আশাবাদী সংশ্লিষ্টরা। নরসিংদীর কৃষি সম্প্রসার অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলার শিবপুর, বেলাব ও রায়পুরা উপজেলার লাল মাটিতে প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম ও খনিজ উপাদান বিদ্যমান। তাই এখানে লটকনের ফলন ভালো হয়। আবার চাষিরাও লটকন আবাদে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে। এ কারণে লটকের আবাদ প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। লটকন বাগানের মালিকেরা জানান, বিনাশ্রমে ও বিনাব্যয়ে লটকন ফল চাষে যে লাভ পাওয়া যায়, তা অন্য কোনো ফল-ফসল বা শাকসবজি চাষে কল্পানাও করা যায় না।
স্থানীয় লকটন চাষিরা জানান, একসময় ঝোপ-জঙ্গল ও বাড়ির আঙ্গিনায় লটকন গাছ রোপণ করতেন। প্রায় ৩০ বছর আগে প্রথম বেলাবো উপজেলার লাখপুর গ্রামে অপ্রচলিত ফল লটকনের আবাদ শুরু হয়। এরপর থেকে বেলাব ও শিবপুর উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের লালমাটির এলাকায় লটকন চাষের প্রসার ঘটতে থাকে। দিন দিন মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে খাদ্য ও পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ লটকনের চাহিদা বাড়তে থাকে। বাজারে ব্যাপক চাহিদা ও লাভজনক হওয়ায় প্রতি বছরই লটকনের চাষে ঝুঁকছেন কৃষক। বিশেষ করে বেলাব ও শিবপুর উপজেলায় গত ৩০ বছরে বাণিজ্যিকভাবে লটকনের প্রসার ঘটেছে। দুই উপজেলার প্রায় পরিবারের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি লটকন। লটকন চাষ করে ভাগ্যের চাকা ঘুরানোর পাশাপাশি, বেকার সমস্যার সমাধানের পথ খুঁজে পেয়েছেন অনেকে।
লটকন চাষি ও স্থানীয় কৃষি অফিস জানায়, গাছের গোড়া থেকে শুরু করে প্রধান কা-গুলোতে ছড়ায় ছড়ায় ফলন হয় এই লটকনের। লটকন গাছ রোপণের তিন বছরের মধ্যে ফলন আসে। ফল দেয় টানা ২০ থেকে ৩০ বছর। লটকনের বাজারজাত নিয়েও দুশ্চিন্তা নেই চাষিদের। কারণ মৌসুমি ব্যবসায়ীরা লটকন কাঁচা থাকা অবস্থায় বাগান কিনে নেন। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা পাকা লটকন বাগান থেকে সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করেন। মৌসুমী ফল লটকন বেচাকেনাকে কেন্দ্র করে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের রায়পুরার মরজাল ও শিবপুর উপজেলা সদরে বসত বাজার।
বেলাব উপজেলার আমলাব ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও লটন চাষি মো. নুরুল হাসান জানান, তার ২৯ কানি জমিতে একটি লকটন বাগান রয়েছে। বাগানটিতে ৭০০ লটকন গাছ রয়েছে। বাগানটি এবার তিনি পাইকারের কাছে ১২ লাখ টাকা বিক্রি করছেন। বাজার দর-দাম ভালো, প্রতি মণ লটকন বাজারে আকার বেধে বিক্রি হচ্ছে ২৫০০ থেকে ৫ হাজার টাকায়।
নরসিংদীর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর উপপরিচালক ড. মো. ছাইদুর রহমান বলেন, লটকন চাষ বৃদ্ধিতে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে চারা উৎপাদন করাসহ কৃষকদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়া হচ্ছে । তাছাড়া লটকনে রোগবালাইয়ের তেমন সংক্রমণ না হওয়ায় উৎপাদন খরচ কম ফলনও ভালো হয়। বাজারে লটকনের ন্যায্য দাম পাওয়ায় লটকনচাষিও লাভবান হচ্ছেন।
বর্তমানে আগাম জাতের কিছু লটকন পাওয়া যায়। যার খুচরা মূল্য প্রতি কেজি ৯০-১০০ টাকা।
লেখক : কৃষি তথ্য কেন্দ্র সংগঠক (সংযুক্ত), আঞ্চলিক কৃষি তথ্য অফিস, ঢাকা, মো:- ০১৯১১৮৪০১৬৬, ই-মেইল : নধৎঁধধ@ুসধরষ.পড়স